বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ অপরাহ্ন
সাঈদুর রহমান রিমন: ৬ষ্ঠ জনশুমারি ২০২২ অনুসারে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। জনসংখ্যার প্রায় ২৮ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯-এর মধ্যে। শৈশব এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝামাঝি সময়কে তারুণ্য বলা হয়। আরেকভাবেও বলা যায় যে, ‘যার মধ্যে সৌন্দর্য, সজীবতা, জীবনীশক্তি, উদ্দীপনা ইত্যাদি থাকে সেই তো তরুণ।’ বিশ্বের বড় বড় বিজয় ও সাফল্য এসেছে এই তরুণদের হাত ধরেই। আর প্রবীণদের প্রজ্ঞা ও পরামর্শ, নবীনের বল-বীর্য, সাহস ও উদ্দীপনায় বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথই ঘুরিয়ে দিয়েছে। অসম্ভবকে সম্ভব করতে ঝুঁকি নিতে পারে শুধু তরুণরাই।
বিশ্ব জুড়ে যখন তারুণ্যের এত উৎসব তখন আমাদের তরুণেরা কী করছে। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার বিষয় এখন তরুণদের বিপথে যাওয়া, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া, মাদক সম্পৃক্ততা, অপরাধী গ্যাং এ সক্রিয় থাকাসহ হাজারো অপরাধ অপকর্মে ধ্বংসের মিছিলে সামিল হওয়ার বিষয়াদি। এদেশেই হলি আর্টিজানের ভয়াবহ হামলার পর পাঁচ তরুণের অস্ত্রসহ হাস্যোজ্জ্বল ছবি আমাদের চিন্তা ভাবনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মাদকে জড়িয়ে আরেক ঐষী তার বাবা মায়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে গোটা দেশকে ফেলেছিল ভাবনার সাগরে। এসব হতাশার মধ্যেই কী শুধু ডুবে আছি আমরা?
গুগল নিউজে ফলো করুন আরটিভি অনলাইন
না, আমাদের তারুণ্য নানা ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সফলতার অনেক চমকও কিন্তু দেখিয়েছে। আশা জাগিয়েছে গোটা জাতিকে। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ‘হিজরত’, ঘর ছেড়েছেন সাত তরুণ, ‘হিজরত করা তরুণদের পাহাড়ে ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো’ -গণমাধ্যমের এসব শিরোনাম আমাদেরকে বারবারই হতাশায় ফেলেছে, তবে বারবার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তুলে এনে আকাশসম স্বপ্নও তো দেখিয়েছে তরুণরাই।
এতো এতো হতাশা নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও প্রযুক্তি মহাসড়কে পাল্লা দেয়া তরুণরা সমৃদ্ধির গতি আনছে। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনেক তরুণ ঘরে বসেই বিদেশী মূদ্রা আয় করছে। তাদের নিত্য নতুন উদ্ভাবন বিশ্বকেও চমকে দিচ্ছে। আমাদের তরুণদের যোগ্যতার কোন অভাব নেই। তাদের কেউ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতের চূড়ায় গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা পুঁতে এসেছেন। ক্রীড়াঙ্গনের মূল শক্তিটাও তো তারুণ্যের। তাদের হাত ধরেই ক্রিকেট বিশ্বে অনন্য এক বাংলাদেশের পরিচিতি ছড়িয়ে আছে। নারী ফুটবলেও আশা জাগানিয়া নানা সাফল্য দেখতে পাচ্ছেন দেশবাসী।
মেহেরপুরের এক প্রিয়াংকা হালদার একক প্রচেষ্টাতেই ঠেকিয়ে দিয়েছে ১১৫টি বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রিয়াংকার যাত্রাটা এতোটাও সহজ ছিল না। ২০১৩ সালে যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন, তখন প্রথম জানতে পারেন বাল্যবিয়ে সম্পর্কে। বাবার সহায়তায় ঠেকিয়ে দেন এক সহপাঠীর বিয়ে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাননি। মেহেরপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সহপাঠী থেকে শুরু করে সিনিয়র আপুদের বাল্যবিবাহও ঠেকিয়ে দেন প্রিয়াংকা। একটা সময় ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায়- মেহেরপুরে যেখানে বাল্যবিবাহ, সেখানেই প্রিয়াংকা। এমনও হয়েছে, মেয়েপক্ষের বাড়িতে বাধা দিতে যাওয়ায় তাকে উল্টো বেঁধে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। তবুও থামেনি প্রিয়াংকার যুদ্ধ, সফলতা তিনি এনেই ছেড়েছেন।
আমাদের তরুণরা সামাজিক কর্মকাণ্ডসহ আর্ত মানবতার কাজেও পিছিয়ে নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী একজন মুহাম্মাদ আবু আবিদ মাত্র চার বছরের প্রচেষ্টায় ত্রিশ হাজার তরুণের বিশাল মানবিক প্ল্যাটফর্ম গড়তে সক্ষম হয়েছেন। দূর্বার তারুণ্য নামের এ ফাউন্ডেশনের মূল মন্ত্রই হচ্ছে- একা ‘আমি’ অনেক কিছু পারি না, তবে ‘আমরা একত্রে’ সব কিছুই পারি। একতাবদ্ধ হয়ে আমরা সমাজ পাল্টে দিতে পারি- পারি গোটা দেশকেও বদলে দিতে।
এ তরুণরা শুধু মানুষ নয়, সকল প্রাণীকুলের জন্যই সহায়তার হাত বাড়িয়ে থাকে। অতি বন্যা, জলোচ্ছাস, ডেঙ্গু কিংবা করোনাকালীন ভয়াল দুর্যোগে দূর্বার তারুণ্য যেমন মানুষের পাশে ছুটে গেছে, তেমনই অসহনীয় খরতাপে হাজির হয়েছে গবাদিপশু থেকে শুরু করে কুকুর, বিড়াল, পাখ-পাখালীর কাছেও। বন্য পশু পাখিদের জন্যও যখন বন, পাহাড়ের বৃক্ষ লতায় পানিভর্তি পাত্র বেধে তারই প্রমাণ দিয়েছে।
দৃষ্টান্ত সৃষ্টির ব্যতিক্রম সব কর্মসূচি নিয়েই আর্ত মানবতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন দূর্বার তারুণ্যের স্বেচ্ছাসেবীরা। গেল ঈদ-উল-ফিতরে হঠাৎই ঘোষণা হলো, ঈদে স্বজন পরিজনহীন থাকেন যারা তাদেরকে খাওয়ানো হবে ঈদের সেমাই। ৪০টি জেলায় সড়কে আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্য, এতিমখানায় থাকা শিশু-কিশোর এমনকি হাসপাতালের শয্যায় থাকা রোগীদের কাছে ঈদ সেমাই, পায়েস, জর্দা, ভূনা খিচুড়ির ডালা সাজিয়ে হাজির হলেন দূর্বার তারুণ্যের স্বপ্নবাজ কর্মিরা।
এখন চলছে দেশব্যাপী একযোগে গাছ রোপন ও পরিচর্যার মাধ্যমে সবুজ ছায়া গড়ে তোলার অনন্য উদ্যোগ। ‘আমরা মালি’ নামের এ কর্মসূচির আওতায় বাড়ির আঙ্গিনা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সড়ক-গ্রামীণ রাস্তা সবুজায়নের বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। এছাড়াও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, শহরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান, মশক নিধনসহ বহুমুখী সামাজিক কাজে চমৎকার ভূমিকা রাখছে দূর্বার তারুণ্য।
এমন নিঃস্বার্থের সামাজিক ও মানবিক কাজে তরুণরা এগিয়ে এলে মানুষ আশান্বীত হয়ে ওঠে, বেঁচে থাকার সাহস পায়। দেশের ব্যাপারেও ফিরে আসে পজেটিভ ভাবনা। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সকল কল্যাণমূলক কাজে তরুণদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। বর্তমান তরুণসমাজ স্মার্ট প্রজন্ম হিসেবে সুপরিচিত। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, পরিবেশ জ্ঞান, সামাজিক ন্যায্যতা ও সাম্য এবং নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে তরুণ সমাজ তাদের উদ্ভাবনী ধারণা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতায় অগ্রগামী ভূমিকা পালনে নানা নজির রেখে চলছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ থেকে পাশ করা তিন বন্ধুসহ সাত তরুণ মিলে তৈরী করেন রিভেরী পাওয়ার এন্ড অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে এই প্রতিষ্ঠান ৩৫০ জনেরও বেশি প্রকৌশলী নিয়ে বড় একটি টিম ও শক্ত একটি ইন্জিনিয়ারিং প্লাটফর্ম তৈরী করেছে- যারা যে কোন জটিল প্রকল্পের/সমস্যার বাস্তবায়ন/সমাধান করতে সক্ষম। বিদ্যুৎ খাতে রিভেরী টিম প্রযুক্তিগত যে উৎকর্ষ সাধন করেছে, তা বাংলাদেশের গর্ব। শুধু প্রযুক্তিগত সমাধানই নয়, রিভেরী আন্তর্জাতিক মানের ট্রান্সফরমার, সুইচগিয়ারসহ নানা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও তৈরী করছে। বিদ্যুত খাতে চমক দেখানো স্বপ্নবাজ তরুণরা হচ্ছেন, মোঃ জাহিদ হোসেন, মোঃ জাহাঙ্গীর আল জিলানী, মোঃ আরিফুল হক, মুস্তাজাব হোসেন, আব্দুর রহমান, এ বি সিদ্দিক ও এস এম ফয়সাল।
গেল বছরে ‘ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টিতে’ নির্বাচিত হন বাংলাদেশি তারুণ্য অপর ৭ জন। ৩টি ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি প্রাপ্তরা হলেন, কনজিউমার টেকনোলজিতে-আজিজ আরমান ও দীপ্ত সাহা, মিডিয়া, মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপ- রুবাইয়াত ফারহান ও তাসফিয়া তাসবিন, স্যোসাল ইমপ্যাক্ট- জাহ্নবী রহমান, আনোয়ার সায়েফ ও সারাবন তহুরা।
বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি বিশাল অংশ তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজেদের গড়ে তুলছে। পোশাক, খাদ্য, মৎস্য, চামড়া, আইটি আর পোলট্রিসহ সব ধরণের কাজেই অবদান রাখতে শুরু করেছে এসব তরুণেরা। তবে তাদের এই পথচলাটা মোটেও সহজ নয়। পদে পদে তাদের বাধার সম্মুখিন হতে হয়। তারপরেও এসব তরুণ উদ্যোক্তারা এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান জাতিকেও।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক/ সম্পাদক, দৈনিক দেশবাংলা